Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব

আলী শাহান শাহ্ বাবা আদম কাশ্মিরী: জন্ম পনেরো শতক, মৃত্যু ১৬১৩ সাল। ধর্মপ্রচারক ও পীর ছিলেন। বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হুসায়েন শাহ কর্তৃক আতিয়ার জায়গিরদার নিযুক্ত হয়েছিলেন বলে জানা যায়। ১৫৯৮ সালে জনকল্যাণের উদ্দেশ্যে আলী শাহান শাহ্ বাবা আদম কাশ্মিরীকে আতিয়া পরগণা দান করা হয়। আতিয়া শব্দের অর্থও দান। তিনি দীর্ঘ ১৫০ বছর পরমায়ু লাভ করেছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে। তিনি নিজের ব্যয়ের জন্য রাজকোষ থেকে সামান্য কিছু অর্থ গ্রহণ করে অবশিষ্ট অর্থ জনকল্যাণে যেমন : মক্তব, মাদ্রাসা, রাস্তাঘাট তৈরিতে ব্যয় করতেন। তাঁর আমলে উৎকৃষ্ট শ্রেণীর কাগজ তৈরি হতো আতিয়াতে। শাহন শাহ্ বাবা কাশ্মিরী ১৬১৩ সালে মৃত্যুবরণ করলে আতিয়াতেই তাকে সমাহিত করা হয়। আজও আতিয়াতে তাঁর মাজার আছে। মৃত্যুর পূর্বে বাবা কাশ্মিরী প্রিয়ভক্ত সাঈদ খাঁকে আতিয়া পরগণার শাসনভার অর্পণ করেন এবং তাঁর পরামর্শক্রমে সুবেদার ইসলাম খাঁর সুপারিশে দিল্লির মোগল বাদশাহ জাহাঙ্গীর ১৬০৮ সালে সাঈদ খাঁকে আতিয়া পরগণা ও বাবা কাশ্মিরীর ভাগিনা শাহজামানকে কাগমারী পরগণার শাসনর্কতা নিয়োগ করেন। এই সাঈদ খাঁ করটিয়া জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা।

শাহজামান: জন্ম আনুমানিক ষোলোশতক। মৃত্যু ১৬৬৩ সালে। তিনি ঐতিহাসিক কাগমারী পরগণার সুশাসক ও আধ্যাত্মিক প্রজ্ঞা বিশিষ্ট আলেম হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় টাঙ্গাইল পিতল, কাঁসা, তাঁতবস্ত্র, দই, মিষ্টি ইত্যাদিতে সুখ্যাতি অর্জন করে। তিনি কাগমারীতে একটি মক্তব স্থাপন করেন। পরবর্তীতে মওলানা ভাসানী এখানে এম.এম আলী কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। শাহজামান ছিলেন আতিয়া পরগণার শাসনকর্তা বাবা আদম শাহ্ কাশ্মিরীর স্নেহে পালিত ভাগ্নে। বাবা কাশ্মিরীর অনুরোধেই বাংলার মোগল সুবেদার ইসলাম খাঁ ১৬০৮ সালে কাগমারী পরগণার শাসনকর্তা হিসেবে শাহজামানকে নিযুক্ত করেন। ১৬০৮ সালে কাগমারী পরগণায় শাসনর্কতা নিয়োগের সময় শাহজামানের বয়স ছিলো ৩০ বছর। তিনি একটানা ৫০ বছর নিযুক্ত ছিলেন কাগমারী পরগণার শাসকরূপে। তিনি সুবেদার ইসলাম খাঁর আদেশে প্রথম কাগমারীতে ভূমি জরিপ করেছিলেন। প্রজাদের চিকিৎসার জন্য তিনি পরগণার কয়েকটি জায়গায় চিকিৎসক নিয়োগ করে দাওয়াখানা স্থাপন করেন।

মৌলভী মোহাম্মদ নঈমউদ্দিন: মৌলভী মোহাম্মদ নঈমউদ্দীন ১৮৩২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইল সদর উপজেলার সুরুজ গ্রামে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মৌলভী মোহাম্মদ রুকন উদ্দিন। নইমউদ্দিন উপমহাদেশের মুশির্দাবাদ, এলাহাবাদ, জৈনপুর, বিহার, আগ্রা, দিল্লি প্রভৃতি স্থানের দেশবরেণ্য বিখ্যাত আলেম ও ইসলামি চিন্তাবিদদের নিকট থেকে ইলমে শরীয়ত (জাহেরী) ও ইলমে মারেফাত (বাতেনী বিদ্যা) আয়ত্ত করেন। তিনিই সর্বপ্রথম কোরান ও বোখারী শরীফ অনুবাদ করে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। আপাত দৃষ্টিতে দেখা যায় গিরিশ চন্দ্র সেন পবিত্র কোরানের প্রথম সম্পূর্ণ অনুবাদ করেন; এই অনুবাদ কর্মের প্রথম পথিকৃত মৌলভী নঈমউদ্দিনই। মৌলভী নঈমউদ্দিন কর্তৃক বাংলায় অনূদিত কোরান শরীফের প্রথম খন্ড ১৮৯১ সালে করটিয়ার জমিদার হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নীর আনুগত্যানুসারে মৌলভী গোলাম সারোয়ার সাহেবের সহযোগিতায় করটিয়া মাহমুদিয়া প্রেসে মুদ্রিত ও মীর আতাহার আলী কর্তৃক প্রকাশিত। পৃষ্ঠা ৪০৬ (৬+৪০০) হাদিয়া ২ টাকা ৪ আনা। টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত প্রথম পত্রিকা ‘আখবারে এছলামিয়া’করটিয়া জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনিই সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন ১৮৮৩ সালে। পত্রিকাটি সুদীর্ঘ দশ বছর প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ছোটো বড় মিলিয়ে অর্ধশত গ্রন্থ রচনা করেন। তার উল্লেখযোগ্য বই হলো জোব্দাতুল মাসায়েল (১৮৯২), এনসাফ (১৮৯২), এজবাতে আখেরেজ্জোহর (১৮৮৭), ফতোয়ায়ে আলমগীরী (১৮৯২), কলেমাতুল কোফর (১৮৯৭) ইত্যাদি। ১৯০৮ সালে ২৩ নভেম্বর এই জ্ঞানতাপস মৃত্যুবরণ করেন।

হেমচন্দ্র:

 ইতিহাসের পাতায় গোপালপুর উপজেলার হেমনগর রাজবাড়ি উল্লেখযোগ্য। হেমনগর রাজবাড়ির রাজা ছিলেন রাজা হেমচন্দ্র। বিখ্যাত আম্বাবীয়ার জমিদার বংশের কালীচন্দ্র চৌধুরীর পুত্র হেমচন্দ্র চৌধুরী। জন্ম ১৮৩৩ সালে। তার নামেই এলাকাটির নাম হয়েছে হেমনগর। তিনি পুখুরিয়া পরগণার একআনি অংশের জমিদার ছিলেন।

হেমবাবু প্রজাকল্যাণে রাস্তাঘাট, পুকুর ইত্যাদি নির্মাণ করেন। পারিবারিকমন্ডলে হেমনগর হিতৈষী নামে পত্রিকা প্রকাশ করেন। তাঁর বাড়িতেই বর্তমানে হেমনগর কলেজ স্থাপিত। তিনি শিক্ষা প্রসারের জন্য হেমনগরে তাঁর মায়ের নামে শাশীমুখী উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এছাড়া তিনি গোপালপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে গৃহ নির্মাণ কল্পে জমিদানসহ পিংনা ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিকেল স্কুল, গোপালপুর বালিকা বিদ্যালয় এবং বরিশাল মুক ও বধির বিদ্যালয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ দান করেছিলেন। প্রজাদের স্বাস্থ্যসেবার কথা বিবেচনা করে হেমনগরে স্থাপন করেন হরদূর্গা দাতব্য চিকিৎসালয়। ম্যালেরিয়ার স্বর্গরাজ্য বলে কথিত এ অঞ্চলে বিংশ শতকের প্রথমার্ধে হেমবাবু

ডাকঘর মারফত মাসিক ১৫ পাউন্ড কুননিল ঔষধ বিতরণ করতো। এছাড়া পিংনা দাতব্য চিকিৎসালয়, ময়মনসিংহ ভিক্টোরিয়া হাসপাতাল নির্মাণে, ময়মনসিংহ পুরাতন হাসপাতালের সৌধ নির্মাণে অনেক অর্থ দান করেছেন। তৎকালে দুর্গম চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ পাহাড়ে তীর্থযাত্রীদের জন্য লোহার সেতু স্থাপনের জন্য সিংহভাগ অর্থ তিনিই প্রদান করেছেন। কবি ও গীতিকার হিসেবে হেমবাবুর তৎকালে সুনাম ছিলো। তাঁর কয়েকটি কবিতার বইও প্রকাশিত হয়েছিলো। হেমচন্দ্র চৌধুরীর বাড়িতে নাট্যশালাও ছিলো। তবে হেমবাবুর প্রজানিপীড়নের চিত্র পাওয়া যায়। ১৯১৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

নবাব বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী:

 টাঙ্গাইলের ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের অন্যতম হলেন ধনবাড়ির নবাব বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী। ১৮৬৩ সালে ২৯ ডিসেম্বর ধনবাড়ি জমিদার পরিবারে তার জন্ম। পিতার নাম জনাব আলী চৌধুরী ও মাতার নাম সাইয়েদা রাবেয়া খাতুন। নওয়াব আলী চৌধুরী ১৯০৬ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভার সদস্য, ১৯১২ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত বাংলা প্রেসিডেন্সী ব্যবস্থাপক সভার সদস্য, ১৯১৬ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত ভারতীয় আইনসভার সদস্য, ১৯২১ সালে বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য এবং ১৯২৩ ও ১৯২৫ সালে দুই দুই বার কৃষি ও শিল্প বিভাগের মন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হন। তিনি ১৯০৬ সালে খান বাহাদুর, ১৯১১ সালে নবাব বাহাদুর এবং ১৯১৮ সালে সি আই ই খেতাব লাভ করেন। তিনি নওয়াব ইনস্টিটিউশন, নওয়াব প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়াও বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনে অকাতরে অর্থ ব্যয় করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নওয়াব আলী চৌধুরী অপরিমেয় অবদান রেখেছিলেন, একথা সর্বজনবিদিত। বঙ্গভঙ্গ রদের পর ১৯১২ সালের ৩ ও ৪ মার্চ কলিকাতায় নওয়াব সলিমুল্লার সভাপতিত্বে ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’-এর পঞ্চম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এতে নওয়াব আলী চৌধুরীর তিনটি প্রস্তাব গৃহীত হয় : (১) উচ্চশিক্ষায় পূর্ববাংলা ও আসামের অধিবাসীদের আপেক্ষিক পশ্চাৎপদতার নিরিখে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ ঢাকায় একটি শিক্ষাদায়ক ও আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাবকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানায়। মূলত এ থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৯১২ সালের ৩১ জানুয়ারি ভারত সরকার কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ঘোষণার পর থেকে ১৯২০ সালের ২৩ মার্চ, অর্থাৎ যে দিন ভারতের কেন্দ্রীয় আইন সভায় ‘১৯২০ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ্যাক্ট নম্বর ১৮’পাস হয়। সেদিন পর্যন্ত নওয়াব আলী চৌধুরীর চেষ্টার কোনো বিরাম ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির অন্যতম সদস্যরূপে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় পরিকল্পনা ও কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯১২-১৯২০ সালে পর্যন্ত নওয়াব আলী চৌধুরী ব্রিটিশ-রাজের সাথে নানাভাবে দেন-দরবার ও আইনসভায় বিল উত্থাপন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় ক্রমাগত ব্রিটিশ সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টি করেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অর্থাভাব দেখা দিলে নিজের জমিদারির একাংশ বন্ধক রেখে ৩৫ হাজার টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে দান করেন। ছাত্রদের বৃত্তির জন্য দান করেন ১৬ হাজার টাকা। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট ভবনের নামকরণ করেন এই মহৎ ব্যক্তির নামে। বাংলাভাষার প্রতি এই মানবদরদির ভালোবাসাও ছিলো অকৃত্রিম। যার বহিঃপ্রকাশ করেছিলেন বাংলাভাষাকে অবিভক্ত বাংলার রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির জন্য ব্রিটিশ সরকারকে আনুষ্ঠানিক পত্র লিখে। এই বরেণ্য ব্যক্তির উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে ঈদুল আজহা (১৯০০), মৌলুদ শরীফ (১৯০৩), ভারনাকুলার এডুকেশন ইন বেঙ্গল (১৯০০) এবং প্রাইমারি এডুকেশন ইন রুরাল এরিয়াস (১৯০৬)। ১৯২৯ সালে ১৭ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

নওশের আলী খান ইউস্ফজী:

 জন্ম ১৮৬৪ সালে কালিহাতির চারান গ্রামে। পিতা শওহার আলী। ত্রিরত্ন আব্দুল হামিদ খান ইউস্ফজী (১৮৪৫-১৯১০), রেয়াজউদ্দীন আহমদ মাশহাদী (১৮৫৯-১৯১৯) ও নওশের আলী খান ইউস্ফজী (১৮৬৪-১৯২৪) কেবল সমসাময়িক ও পারস্পরিক আত্মীয় ছিলেন না, তাঁরা একই পথের পথিক ছিলেন।

টাঙ্গাইল মহকুমায় মুসলিম সমাজে তিনিই প্রথম এফএ পাস করেন ১৮৮৭ সালে। উল্লেখ্য, টাঙ্গাইল জেলায় তিনিই প্রথম মুসলমানদের মধ্যে এফএ পাস ব্যক্তিত্ব। তিনি ১৮৮৯ সালে পাকুল্লায় সাব-রেজিস্টার পদে চাকুরি গ্রহণ করেন। বিভিন্ন ধরনের লেখালেখি করলেও গদ্যে ছিল তাঁর ভালো দখল। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাবলির মধ্যে ‘বঙ্গীয় মুসলমান (১৮৯১)’, ‘শৈশব-কুসুম (১৮৯৫ কবিতার বই, আহম্মদী প্রেস টাঙ্গাইল, ১৩০২ বাং)’, ‘দলিল রেজেস্টরি শিক্ষা (১৮৯৭)’, ‘মোসলেম জাতীয় সঙ্গীত (১৯০৯)’, ‘সাহিত্য প্রভা (১৯১৪)’ইত্যাদি। তিনি ৯ মে ১৯২৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

ওয়াজেদ আলী খান পন্নী (চাঁদ মিয়া): 

১৮৭১ সালে ১৪ নভেম্বর সদর উপজেলার অন্তর্গত করটিয়ার বিখ্যাত জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ওয়াজেদ আলী খান পন্নীর পিতার নাম হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নী। মাতার নাম খোদেজা খানম। তিনি ছিলেন করটিয়ার জমিদারদের মধ্যে সবচেয়ে প্রজাহিতৈষী। তিনি জমিদার তথা ময়মনসিংহ জেলা কংগ্রেস ও খেলাফত কমিটির সভাপতি, বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সহ-সভাপতি এবং নিখিল ভারত কংগ্রেসের নির্বাহী পরিষদ সদস্য হওয়া সত্ত্বেও ব্রিটিশ বিরোধী আযাদী আন্দোলন করে কারাবরণ করেন ১৯২১ সালে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তাঁর অনমনীয় মনোভাব ও দৃঢ়তার জন্য ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত তাঁর তৈলচিত্রের নিচে লেখা রয়েছে- “One who dified the British.”

চাঁদ মিয়া পিতার প্রতিষ্ঠিত মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে উচ্চ ইংরেজি শিক্ষার বিদ্যালয়ে উন্নীত করে ‘হাফেজ মাহমুদ আলী ইনস্টিটিউশন’নামকরণ করেন ১৯০১ সালে। ইংরেজ মি. স্মিথকে নিযুক্ত করেন প্রধান শিক্ষক হিসেবে। ওয়াজেদ আলী খান পন্নীর উদ্যোগে করটিয়ায় ১৯০৬ সালে সারা বাংলার মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ্। এই ধারাক্রমে ১৯১০ সালে করটিয়ায় ইতিহাস খ্যাত মুসলিম এডুকেশন কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। চাঁদ মিয়া প্রতিষ্ঠিত পিতামহের নামে করটিয়ার স্থাপিত ‘সা’দত কলেজ’(১৯২৬ সালে) টাঙ্গাইল তথা বৃহত্তর ময়মনসিংহে শিক্ষা বিস্তারে গর্বোন্নত শিরে দাঁড়িয়ে আছে। এটি বাংলাদেশে মুসলমান প্রতিষ্ঠিত প্রথম বেসরকারি কলেজ। একই বছর অর্থাৎ ১৯২৬ সালে স্ত্রীর নামে রোকেয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও তিনি বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পত্র-পত্রিকা, বই পুস্তক প্রকাশনায় অর্থ দান করেছেন। চাঁদ মিয়া ১৯২১ সালে আলীপুর (কলিকাতা) জেলে থাকাকালীন ব্যারিস্টার আবদুস রসুল প্রতিষ্ঠিত ও মুজিবুর রহমান সম্পাদিত ‘দি মুসলমান’পত্রিকার জন্য আর্থিক সাহায্যদান। জনহিতকর কাজের ব্রতে তাঁর বার্ষিক লক্ষ টাকা আয়ের জমিদার ওয়াকফ্ করেছেন। এই ওয়াকফ্ থেকে বৃত্তি পেয়ে ফজিলাতুননেছা জোহা ও এ জববার (চীফ ইঞ্জিনিয়ার) বিদেশে গমন করেন। ব্রিটিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে করটিয়ায় ন্যাশনাল স্কুল স্থাপন করে শত শত চরকা বসান। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অনেক ব্যারিস্টার, হাকিম, চাকুরিজীবী যোগ দিয়েছেন কিন্তু চাঁদ মিয়ার মতো চারলক্ষ টাকা আয়ের ভূম্যাধিকারী নিজেরও সম্পদের মায়া বিসর্জন দিয়ে আন্দোলনে নেমেছিলেন কিনা তা আমাদের জানা নেই।

জমিদারদের স্বার্থ রক্ষায় বৃহত্তর ময়মনসিংহের জমিদাররা একটি সংগঠনের জন্য পাঁচশত টাকা চাঁদা চাঁদ মিয়ার কাছে চাইলে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, কারণ এই সংগঠন প্রজাদের কল্যাণে প্রবর্তিত প্রজা স্বত্ব আইনের বিরোধিতা করতো। মজলুম নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খাঁন ভাসানী বলতেন এ দেশের জমিদাররা সবাই চাঁদ মিয়ার মতো হলে আমি জমিদারি উচ্ছেদ আইন সমর্থন করতাম না। উল্লেখ্য, দানের ক্ষেত্রে ওয়াজেদ আলী খান পন্নী অদ্বিতীয় ছিলেন। এজন্যই তাকে ‘দানবীর’, ‘দ্বিতীয় মহসিন’উপাধিতে ডাকা হতো। ১৯৩৬ সালে ২৫ এপ্রিল শনিবার তিনি ৬৭ বছর বয়সে করটিয়ায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

স্যার আবদুল করিম গজনবী:দেলদুয়ারের বিখ্যাত জমিদার পরিবারে ১৮৭২ সালে ২৫ আগস্ট আবদুল করিম গজনবীর জন্ম। জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে আবদুল করিম গজনবী রাজনীতিতে সক্রিয় হন। তিনি বঙ্গ বিভক্তির সমর্থক ছিলেন। করিম গজনবী ব্রিটিশপন্থী ছিলেন তাই সরকার কর্তৃক মনোনীত হয়ে স্যার আবদুল করিম গজনবী বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯০৯ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের মুসলমান এলাকা থেকে ইম্পিরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে এবং ১৯১৩ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত বঙ্গ প্রেসিডেন্সির মুসলমান এলাকা থেকে ভাইসরয়েস কাউন্সিলে সরকার মনোনীত সদস্য ছিলেন। আবদুল করিম গজনবী ১৯২৩ ও ১৯২৬ সালে পরপর দু’বার ময়মনসিংহ দক্ষিণ-পূর্ব (মুসলমান) এলাকা থেকে বঙ্গীয় আইনসভায় সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯২৮ সালে ‘নাইট’এবং ১৯৩৩ সালে ‘নওয়াব বাহাদুর’খেতাবে ভূষিত হন তিনি। স্যার আবদুল করিম গজনবী ১৯২৯ সাল থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত বেঙ্গল এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। স্যার আবদুল করিম গজনবী রচিত গ্রন্থ : (১) মুসলিম এডুকেশন ইন বেঙ্গল (২) পিলগ্রিম ট্রাফিক টু হেজাজ এন্ড প্যালেস্টাইন (৩) দি ওয়ার্কিং অব দি ওয়ার্কিকাল সিসটেম ইন বেঙ্গল। ব্রিটিশ রাজ্যের কূটনীতিক হিসেবে অনেকবার সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, মিশর, সৌদি আরব প্রভৃতি দেশে গমন করেন। স্যার আবদুল করিম গজনবী ১৯৩৯ সালের ২৪ জুলাই কলিকাতায় বালিগঞ্জে নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন।

রজনীকান্ত গুহ : ১৮৬৭ সালে ১৯ অক্টোবর ঘাটাইল উপজেলার জামুরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা রাধাপ্রসাদ গুহ, মাতা ত্রিপুরা সুন্দরী। শিক্ষাবিদ, সুপন্ডিত, ব্রাহ্মনেতা ও লেখক। এসব পরিচয়ের পাশে তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় ছিলো তিনি ছিলেন পূর্ববঙ্গের একজন বড় স্বদেশী আন্দোলন কর্মী। এ জন্য তাঁকে কয়েকবার চাকরিচ্যুত করা হয়। তিনি ১৮৯৩ সালে প্রথম শ্রেণীতে এমএ পাস করে, ১৮৯৪ সালে ভবানীপুর এলএমএস কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। কলকাতা সিটি কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন ১৮৯৪-৯৬ সাল পর্যন্ত। ২১ জুন ১৯০১-৩০ জুন ১৯১১ সাল পর্যন্ত বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে প্রথমে অধ্যাপক ও পরে অধ্যক্ষ পদে কাজ করেন। সে সময় স্বদেশী দলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় পদচ্যুত হন। এরপর ১৯১১-৩০ জুন ময়মনসিংহ আনন্দমহন কলেজে, ১৯১৩-কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। সরকারি নির্দেশে পুনরায় পদচ্যুতি ঘটে। এরপর কলিকাতা সিটি কলেজে অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হয়ে পরে ১৯৩৬ সালে এর অধ্যক্ষ হন। বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত, গ্রীক, ফরাসি, ল্যাটিন ভাষা জানতেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ : ১. সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াস (মূল গ্রীক থেকে অনুবাদ) ২. আন্টোনিয়াসের আত্মচিন্তা (গ্রীক থেকে অনুবাদ) ৩. মেগাস্থিনিসের ভারত বিবরণ (অনুবাদ) ৪. সক্রেটিস। ১৩ ডিসেম্বর ১৯৪৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

আবদুল হালিম গজনবী : 

 

টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারে জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ১৮৭৬ সালের ১১ নভেম্বর। তাঁর পিতার নাম আবদুল হাকীম খান গজনবী এবং মাতা ছিলেন রংপুরের পায়রাবন্দর জমিদার যহীর মুহাম্মদ আবু আলীর কন্যা করীমুননেসা খানম। আবদুল হালীম গজনবী লেখাপড়া করেন কলিকাতার সিটি কলেজ-স্কুল ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। ১৯০০ সালে কর্মজীবনের শুরুতে তিনি তদানীন্তন ময়মনসিংহ মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান হন। লোকাল বোর্ডের সদস্য ও অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট এবং কলিকাতা কর্পোরেশনের শেরিফ ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত। তিনি বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বঙ্গভঙ্গের প্রাক্কালে সক্রিয় রাজনীতির সাথে জড়িত হন। এক্ষেত্রে হিন্দু-বাংলার ‘মুকুটহীন রাজা’কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় নেতা সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করেন। এজন্যই সম্ভবত অন্যান্য কংগ্রেসী নেতার মতো তিনিও বঙ্গবিভাগের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। পক্ষান্তরে তাঁর অগ্রজ সহোদর স্যার আবদুল করীম গজনবী ‘১৯০৫ সালে বঙ্গবিভাগ কার্যকর হলে শুধু সমর্থনই করেন নি, বরং কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের বঙ্গবিভাগ বিরোধী আন্দোলন প্রতিহত করারও চেষ্টা করেন।’পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের প্রথম লেফটেন্যান্ট গভর্নর ব্যামফিল্ড ফুলার আব্দুল করীম গজনবীকে ‘রাইট গজনবী’(ন্যায়পন্থী গজনবী) এবং আবদুল হালীম গজনবীকে ‘রং গজনবী;’(পথভ্রষ্ট গজনবী) বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি ১৯২৭, ১৯৩১, ১৯৩৫ সালে বৃহত্তর ঢাকা অঞ্চল থেকে ভারতীয় আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। এছাড়া তিনি ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন কমিটি যেমন : বার্মা সেপারেশন কমিটি (১৯৩০), ফেডারেল ফাইন্যান্স কমিটি (১৯৩২-, কনসালটেটিভ কমিটি (১৯৩৩), রেলওয়ে এ্যাডভাইজারী কমিটি (১৯২৭-৩২), পাবলিক একাউন্টস কমিটি (১৯৩৩), জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটি (১৯৩৩) ও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সংগঠন সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান এসোসিয়েশন’-এর সভাপতি এবং ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন’-এর সহ-সভাপতি ছিলেন। ১৯৫৩ সালে তিনি দেলদুয়ারে মৃত্যুবরণ করেন।

মন্মথনাথ রায় চৌধুরী : 

জন্ম ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৮৮০ সালের সন্তোষ জমিদার পরিবারে। তাঁর পিতা দ্বারকানাথ রায় চৌধুরী ও মাতা বিন্দুবাসিনী রায় চৌধুরানী।তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএল। সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত হন ছাত্রাবস্থায়। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথের শিষ্য ছিলেন। মন্মথনাথ রায় চৌধুরী তৎকালীন বাংলা সরকারের মন্ত্রী ও বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সভাপতি ও একজন ভালো ক্রীড়াবিদ ছিলেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় হিসেবে পরপর ছয়বার তৎকালীন ইন্ডিয়ান ফুটবল এসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন। তিনি কলকাতার সন্তোষ ট্রফি খেলার উদ্যোক্তা। এছাড়া তিনি বেঙ্গলী পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। এছাড়াও তিনি সন্তোষ, টাঙ্গাইলে একাধিক স্কুল ও কলেজের প্রতিষ্ঠাতা। টাঙ্গাইল শহরে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার প্রথম কলেজটি স্থাপন করেন ১৯০০ সালে। ‘প্রমথ-মন্মথ কলেজ’নামে এটি প্রায় দশ বছর চালু ছিলো। পরবর্তী সময়ে এটি ঢাকার জগান্নাথ কলেজের সাথে একীভূত হয়। বর্তমানে কলেজটি না থাকলেও এলাকাটি ‘কলেজপাড়া’নামে পরিচিত।

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী :

ভারতীয় উপমহাদেশের বুভুক্ষু মানুষের মজলুম নেতা। যেখানে অন্যায়-অবিচার সেখানেই একটি প্রতিবাদী কণ্ঠ, একটি ভূকম্পিত হুঙ্কারের নাম মওলানা ভাসানী। ১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর পূর্ববঙ্গের প্রবেশপথ খ্যাত সিরাজগঞ্জ জেলার সয়াধানগড়া গ্রামে এক বনেদি মুসলিম পরিবারে মওলানা ভাসানী জন্মগ্রহণ করেন। মওলানা ভাসানীর পিতার নাম হাজী শরাফত আলী খান। সিরাজগঞ্জ জন্মগ্রহণ করলেও টাঙ্গাইলে বিবাহ করে জীবনের অধিকাংশ সময় স্থায়ীভাবে বসবাস করেছেন বলে ভাসানী টাঙ্গাইলের অধিবাসী হিসেবে বেশি পরিচিত। জীবনের প্রথমার্ধে তিনি ব্রিটিশ বিরোধী নেতা মওলানা মোহাম্মদ আলী, মওলানা শওকত আলী, মওলানা আবুল কালাম আজাদ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। ১৯২৬-এ আসামে প্রথম কৃষক-প্রজা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান। ১৯২৯-এ আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসান চরে প্রথম কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠান। এখান থেকে নামের শেষে ভাসানী শব্দ যুক্ত। ১৯৩১-এ সন্তোষের কাগমারীতে, ১৯৩২-এ সিরাজগঞ্জের কাওরাখোলায় ও ১৯৩৩-এ গাইবান্ধায় বিশাল কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠান। ১৯৩৭-এ কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগদান। একই বছর আসামে বাঙালি নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ‘লাইনপ্রথা’চালু হলে এই প্রথা-বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ১৯৪০-এ শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের সঙ্গে মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত ও পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণ। তিনি ১৯৪৪ আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। এ সময় দল ও দলের বাইরে বাঙালি কৃষকদের অধিকার আদায়ে দুর্বার আন্দলন গড়ে তোলেন। ভাসানী ১৯৪৯ সালে পাকিস্তানে প্রথম বিরোধীদল ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’গঠন করে এর সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তার সাহসী ভূমিকা উজ্জ্বল হয়ে আছে। ১৯৫২-র ৩০ জানুয়ারি ঢাকা জেলা বার লাইব্রেরি হলে তাঁর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত এবং এর অন্যতম প্রধান সদস্য নিযুক্ত। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন (ফেব্রুয়ারি ১৯৫২)-এ সহযোগিতার জন্য গ্রেফতার। ১৬ মাস কারানির্যাতন ভোগ। পূর্ববঙ্গ পরিষদের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে মোকাবেলা করার লক্ষ্যে ১৯৫৩-সালের ৩ ডিসেম্বর কৃষক-শ্রমিক পার্টির সভাপতি শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক ও তাঁর দল নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের আহবায়ক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে যুক্তফ্রন্ট গঠন। নির্বাচন (৮-১১ মার্চ ১৯৫৪)- যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয় অর্জন। যুক্তফ্রন্ট পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা এ.কে. ফজলুল হক কর্তৃক পূর্ববঙ্গে সরকার গঠন (৪ এপ্রিল ১৯৫৪)। ভাসানী পূর্ব বাংলার খাদ্যজনিত দুর্ভিক্ষ রোধকল্পে কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট থেকে ৫০ কোটি টাকা আদায়ের দাবিতে ১৯৫৬-র ৭ মে ঢাকায় অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। সরকার দাবি মেনে নিলে ২৪ মে ১৯৫৬ অনশন ভঙ্গ করেন। এই বছর ১২ সেপ্টেম্বর হোসন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ রিপাবলিকান পার্টির কোয়ালিশন সরকার গঠিত হলে মওলানা ভাসানী কর্তৃক সরকারের মার্কিন ঘেঁষা পররাষ্ট্র নীতির বিরোধিতা। নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ ও পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসন প্রদানের জন্য তৎকর্তৃক সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ। মূলত এ থেকেই সোহরাওয়ার্দী-পন্থীদের সঙ্গে ভাসানীর মতবিভেদ তৈরি হয়।

পাকিস্তানের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ও সামাজিক সম্মেলন তিনিই ডাকেন ১৯৫৭ সালে টাঙ্গাইলের কাগমারীতে। যা কাগমারী সম্মেলন নামে ইতিহাসখ্যাত। এই সম্মেলনে তিনি পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীকে ‘আস্সালামু আলাইকুম’বলে বিদায় জানিয়েছিলোন। কাগমারী সম্মেলনের মধ্যে সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিব-এর সাথে তার বিচ্ছেদ সৃষ্টি হয়েছিল। ভাসানী পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি জানান। প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করলে ১৮ মার্চ ১৯৫৭ আওয়ামী লীগ থেকে ভাসানী পদত্যাগ করেন। একই বছর ২৫ জুলাই ১৯৫৭ তাঁর নেতৃত্বে ঢাকার রূপমহলো সিনেমা হলে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠিত হয়। তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৬-তে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক উপস্থাপিত ৬-দফা কর্মসূচির বিরোধিতা করে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া পরিচালনা করেন ভাসানী। ১৯৬৭ নভেম্বরে ন্যাপ দ্বি-খন্ডিত হলে চীনপন্থী ন্যাপের নেতৃত্ব গ্রহণ। ১৯৬৯-এর জানুয়ারি-মার্চের আইয়ুববিরোধী গণ-আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১-দফা কর্মসূচির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন। আইয়ুব খানের পতনের পর ইয়াহিয়া খান নির্বাচনের ঘোষণা দিলে ভাসানী দাবি তোলেন ‘ভোটের আগে ভাত চাই’, দেশে ‘ইসলামিক সাংস্কৃতিক বিপ্লব’সংঘটন, ‘ইসলামিক সমাজতন্ত্র’কায়েম ইত্যাদি দাবি উপস্থাপন। নির্বাচনের কিছুদিন পূর্বে ১২ নভেম্বর ১৯৭০ পূর্ব পাকিস্তানের উপকূল অঞ্চলে এক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় হলে দুর্গত এলাকায় ত্রাণ কাজকে অগ্রাধিকার দিয়ে এবং পশ্চিমা সরকার ঘূর্ণিদুর্গতদের জন্য কোনো ব্যবস্থা না-নিলে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। ৪ ডিসেম্বর ১৯৭০ ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় সভাপতির ভাষণ দানকালে ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’দাবি উত্থাপন। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্ত্ততি পর্বে ভাসানী শেখ মুজিবুর রহমানের পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলন (৩-২৫ মার্চ ১৯৭১)-এর প্রতি সমর্থন প্রদান করেন।

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২-এর ২ জানুয়ারি ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন। একই বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি ‘হক কথা’প্রকাশ। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও ইন্দিরা গান্ধির মধ্যে যে মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ভাসানী তার বিরোধিতা করেন। তবে তিনি ১৯৭২-এর সংবিধান ও ব্যাংকবীমা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান সরকারের জাতীয়করণ নীতির প্রতি সমর্থন দেন। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে পদ্মা নদীর পানি প্রবাহ বন্ধ করে গঙ্গা নদীতে নির্মিত মরণ বাঁধ ফারাক্কা তুলে দেওয়ার দাবিতে ১৯৭৬ সালে ১৬ মে ইন্দিরা গান্ধি সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য ফারাক্কা মিছিল নিয়ে কানসার্ট সীমান্ত পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। ১৯৭৬ সালের ১ অক্টোবর তার নেতৃত্বে ‘খোদাই খিদমতগার’সংগঠন গঠিত।

সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদ-বিরোধী আন্দোলনের তিনি ছিলেন লড়াকু নেতা। দেশের সমাজতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম ও বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের আন্দোলনে তিনি ছিলেন কিংবদন্তি তুল্য। তাকে বলা হয়ে থাকে ‘অ্যাফ্রো-এশিয়ার নির্যাতিত মানুষের মুকুটহীন সম্রাট। ভাসানীর প্রকাশিত গ্রন্থ, দেশের সমস্যা সমাধান (১৯৬২), মাও সেতুং-এর দেশে (১৯৭৬)।

মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর মৃত্যুরবণ করেন।

আবদুল করিম খান : জন্ম বাংলা ১২৯৯ সালে ২২ মাঘ ঘাটাইল উপজেলার দীঘলকান্দি গ্রামে। পিতা আতা এলাহী খান, মাতা লালেমন নেছা। করিম খান ১৯১০ সালে অনুষ্ঠিত ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন ও ১৯১৪ সালে ঘাটাইল থানার মুসলমানদের মধ্যে প্রথম গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯২০ সালে টাঙ্গাইল মহকুমায় প্রথম মুসলিম আইনব্যাবসায়ী হিসাবে যোগদান করেন। তিনি পিতার প্রতিষ্ঠিত দীঘলকান্দি সমবায় সোসাইটির প্রসার ঘটান। টাঙ্গাইল শহরের কেন্দ্রীয় গোরস্তানটি প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান স্মরণীয়। তিনি গোরস্তানের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে প্রায় চারদশক সেক্রেটারীর দায়িত্ব পালন করেন। নারী শিক্ষা ও মুসলিম তরুণদের শরীর ও মন গঠনের জন্য তৎসময়ে তার অবদান অগ্রগণ্য। টাঙ্গাইল মুসলিম ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাকালীন সেক্রেটারী হিসেবে ইতিহাসে ভাস্বর হয়ে আছেন। তাঁর রচিত তরফ গৌরাঙ্গীর ইতিহাসে (১৯৪২) তৎসময়ে ঘাটাইলে বনেদি পরিবার বা গোষ্ঠী কিভাবে অন্যান্য দিকে বিস্তৃতি লাভ কর তার বর্ণনা তুলে ধরেছেন যা ঘাটাইল তথা টাঙ্গাইল জেলার ইতিহাস অনুসন্ধানের একটি ক্ষেত্র হিসেবে আজও কাজ করছে। তিনি ১৯৮৮ সালের ৮ জুন মৃত্যুবরণ করেন।

প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ :

প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ’র জন্ম ১৮৯৪ সালে, ভুঁঞাপুর উপজেলার বিরামদী (বর্তমানে শাবাজনগর) গ্রামে। পিতার নাম শাবাজ খাঁ, মা রতন খানম। ১৯১৯ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এমএ পাস করেন। ১৯২৩ সালে আইনে বিএল ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। আইন পাস করলেও ওকালতি পেশায় না-গিয়ে তিনি করটিয়া হাফেজ মাহ্মুদ ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কাজে যোগদান করেন।

করটিয়ার জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নী একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা প্রকাশ করলে প্রিন্সিপাল সাহেব সর্বতোভাবে সহযোগিতা প্রদানে এগিয়ে এলেন। ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হলো করটিয়া সা’দত কলেজ। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পেলেন ইবরাহীম খাঁ। তিনি এক টানা ২২ বছর অতি সুনামের সঙ্গে এ গুরুদায়িত্ব পালন করেন।

অবিভক্ত বাংলা ও আসামে সা’দত কলেজই মুসলমান প্রতিষ্ঠিত প্রথম কলেজ এবং ইবরাহীম খাঁ-ই প্রথম মুসলমান প্রিন্সিপাল। করটিয়ায় একটি সাহিত্য পরিমন্ডল গড়ে ওঠে করটিয়া সা’দত কলেজকে কেন্দ্র করে। এর মধ্যমণি ছিলেন ইবরাহীম খাঁ। এখানে পড়াতে এবং পড়তে এসে যাঁরা সাহিত্যচর্চা করেছেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই বাংলা-সাহিত্যে পরিচিত। এঁদের মধ্যে রয়েছেন অধ্যাপক কাজী আকরম হোসেন, অধ্যাপক গোলাম মকুসদ হিলালী, অধ্যাপক আজিমুদ্দিন, মওলানা আহ্সানুল্লাহ, আবুল হাশেম, আবদুল কাদের, নূরুন্নাহার, তালিম হোসেন, অধ্যাপক মুফাখ্খারুল ইসলাম, আশরাফ সিদ্দিকী, খোন্দকার আবুবকর, পিসি সরকার, ইদরিস আলী, রবিঘোষ ঠাকুরতা, খুরশীদ আহমদ, আলীম-আল রাজী, শামসুজ্জামান, মোকসেদ আলী, এএসএম আবদুল জলিল প্রমুখ। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে যাতে সাহিত্য-পিপাসা সৃষ্টি করা যায়, তার জন্য ইবরাহীম খাঁ ‘কাকলি কুঞ্জ’(১৯৪৩) এবং বড়দের সাহিত্যচর্চার কেন্দ্রস্বরূপ মহুয়া মজলিশ’(১৯৪২) প্রতিষ্ঠা করেন। প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ ১৯৪৮ সালে ঢাকায় টাঙ্গাইল মাহফিল (বর্তমান টাঙ্গাইল জেলা সমিতি) প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি পূর্ব পাকিস্তান মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সরকারি দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ১৯৪৮ সালে ভূঞাপুর কলেজ(অধুনা ইবরাহীম খাঁ কলেজ) স্থাপন করেন। ঢাকার মীরপুরস্থ সরকারি বাংলা কলেজটি ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম এবং তাঁর সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল। ১৯৪৬ সালে প্রাদেশিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি এবং একই সালে বাংলার প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৫৭ তে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ১৯৬২ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য (ময়মনসিংহ-২) নির্বাচিত হন। অতঃপর ক্ষমতাসীন কনভেনশন মুসলিম লীগে যোগদান। ১৯৭০-এর ৭ ডিসেম্বরের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে মুসলিম লীগের (কাইয়ুমপন্থি) মনোনয়নে টাঙ্গাইল জেলা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিতহন। ঢাকা ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটর, পাকিস্তান কৃষি ব্যাংক ও বাংলা একাডেমীরও কার্যকরী সদস্য ছিলেন। তিনি ব্রিটিশ আমলে খান সাহেব ও খান বাহাদুর এবং পাকিস্তান আমলে সিতারা-ই-ইমতিয়াজ উপাধি লাভ করেন। ১৯৬৩-তে নাটকে বাংলা একাডেমী পুরস্কার এবং ১৯৭৬-এ একুশের পদক লাভ করেন।

গ্রাম বাংলার সরলপ্রাণ মানুষের ভাষায় লেখা তাঁর ছোটগল্প, নাটক, রসরচনা স্বাতন্ত্র্যের দাবি রাখে। তিনি অনেক পাঠ্যগ্রন্থের প্রণেতা। তাঁর রচিত গ্রন্থের মধ্যে নাটক : কাফেলা, কামালপাশা, আনোয়ার পাশা, রস রচনা : আলু বোখারা, উস্তাদ, মানুষ, শিশুসাহিত্য : ব্যাঘ্র মামা, সোহরাব রোস্তম, শাহনামা। ভ্রমণকাহিনী : ইস্তাম্বুল যাত্রীর পত্র, নয়াচীনে এক চক্কর। অনুবাদ : আরব জাতি, নুরমহল, চেঙ্গিস খাঁ, বাবুর নামা উল্লেখযোগ্য। ইবরাহীম খাঁ ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পান। ১৯৭৮ সালের ২৯ মার্চ তিনি পরলোকগমন করেন।

রণদা প্রসাদ সাহা :

 ১৮৯৬ সালের ১৫ নভেম্বর উত্থান একাদশীতে সাভার এলাকার শিমুলিয়ার কাছোর গ্রামে মামা বাড়িতে রণদা প্রসাদ সাহার জন্ম। পিতার নাম দেবেন্দ্র নাথ সাহা পোদ্দার, মাতা কুমুদিনী দেবী। অতি সাধারণ পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতৃভিটা মির্জাপুরে। চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত মির্জাপুর বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন। তাঁর পিতার আর্থিক সচ্ছলতা ছিল না। রণদা প্রসাদের বয়স যখন সাত বছর, তখন তাঁর মা সন্তান প্রসবকালে ধনুষ্টংকারে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যান। পিতা দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করলে গৃহত্যাগ করেন। চৌদ্দ বছর বয়সে কলিকাতায় গমন এবং বিপ্লবী দলে যোগদান। কয়েকবার গ্রেফতারবরণ। কলিকাতায় মুটের কাজ থেকে শুরু করে নানারকম কাজ সম্পাদন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮) রণদা প্রসাদ সাহার ছন্নছাড়া জীবনের দিন বদল ঘটিয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি সাহসিকতার সাথে অংশগ্রহণ করে কমিশনপ্রাপ্ত হন। পরে সেনাবাহিনী ত্যাগ এবং রেলওয়েতে নিম্নমানের চাকরিতে বহাল। চাকরিতে ইস্তফা দান এবং সঞ্চিত অর্থ দিয়ে শেয়ার ইন্ডাস্ট্রিজের মাধ্যমে গৃহে গৃহে কয়লা সরবরাহের ব্যবসা শুরু। পরবর্তী চার বছরে কলকাতায় একজন বিশিষ্ট কয়লা ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ। এসময় The Bengal River Service Company নামে নৌ-পরিবহন সংস্থা ও নৌ-পরিবহন বীমা কোম্পানি স্থাপন করেন। পাশাপাশি পাটের ব্যবসা, গুদাম, বেইল প্রসেসিংসহ নানা ব্যবসা পরিচালনা করেন। তার মায়ের বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর স্মৃতি তাঁকে আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসার প্রেরণা যোগায়। তিনি মায়ের নামে মির্জাপুরে ‘কুমুদিনী হাসপাতাল’(১৯৩৩) প্রতিষ্ঠা করেন। মেয়েদের শিক্ষার জন্য মির্জাপুরে ‘ভারতেশ্বরী হোমস্’(১৯৬২) এবং টাঙ্গাইল শহরে ‘কুমুদিনী কলেজ’, পিতার নামে মানিকগঞ্জে ‘দেবেন্দ্র কলেজ’প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া মির্জাপুর ডিগ্রি কলেজ, মির্জাপুর সদয়কৃষ্ণ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, করটিয়া সা’দত মহাবিদ্যালয়, ভূঞাপুর ইবরাহীম খাঁ কলেজ, মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজসহ টাঙ্গাইলের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাঁর দান অপরিসীম। তিনি তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কল্যাণধর্মী ও জনহিতকর কাজের স্বার্থে একটি ট্রাস্টভুক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৪৪ সালে গঠন করেন ‘কুমুদিনী ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল।’ট্রাস্টের লভ্যাংশ থেকে শুধু নিজের ও পরিবারের ভরণপোষণ ব্যয় ছাড়া সবটুকুই মানুষের কল্যাণে, শিক্ষা বিস্তারে ও সেবামূলক কাজে ব্যয় করেছেন। বাংলার দুর্ভিক্ষের সময় (১৩৫০ বাং) রেডক্রস সোসাইটিকে এককালীন তিনলক্ষ টাকা দান এবং ক্ষুধার্তদের জন্য চার মাসব্যাপী সারাদেশে দুইশো পঞ্চাশটি ফ্রি-কিচেন খোলা রাখেন।

১৯৭১ সালের ৭ মে রাত ১১টায় তাঁর নারায়ণগঞ্জের বাসা থেকে দেশীয় সহচরের সহযোগিতায় পাকবাহিনী দানবীর রণদা প্রসাদ সাহাকে পুত্র ভবানী প্রসাদ সাহাসহ ধরে নিয়ে যায়। এ সময় তাঁর বয়স হয়েছিল চুয়াত্তরঊর্ধ্ব, পুত্রের সাতাশ। তারপর তাঁদের আর কোনো খোঁজ মেলে নি।

বেগম ফজিলাতুন্নেছা : জন্ম ১৮৯৯ সালে টাঙ্গাইল সদর থানার নামদার কুমুল্লী গ্রামে। পিতার নাম ওয়াজেদ আলী খাঁ, মাতা হালিমা খাতুন। তিনি ১৯২১ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক ও ১৯২৩ সালে প্রথম বিভাগে ইডেন কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। ফজিলাতুন্নেছা ১৯২৫ সালে কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে বিএ পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৭ সালে গণিত শাস্ত্রে এমএ-তে ফার্স্ট ক্লাশ ফার্স্ট (গোল্ড মেডালিস্ট) হয়েছিলেন। অতঃপর তিনি ১৯২৮ সালে বিলেতে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য গমন করেন। নিখিল বঙ্গে তিনিই প্রথম মুসলিম মহিলা গ্র্যাজুয়েট। উপমহাদেশে মুসলিম মহিলাদের মধ্যে তিনিই প্রথম বিলাত থেকে ডিগ্রি এনেছিলেন। তাঁর পড়াশোনার ব্যাপারে করটিয়ার জমিদার মরহুম ওয়াজেদ আলী খান পন্নী (চাঁদ মিয়া) বিশেষ উৎসাহ ও অর্থ সাহায্য করেন। বিলেতে তাঁর অবস্থান কালীন সময়ে ভারতীয় মুসলমানদের মাঝে প্রথম ডিপিআই খুলনা নিবাসী আহসান উল্ল্যাহর পুত্র এ এ জোহাও লন্ডনে ব্যারিস্টারী পড়তে যান। লন্ডনে জোহা সাহেবের সাথে ফজিলাতুন্নেছার পরিচয় হয়। পরে উভয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। লন্ডন থেকে ফিরে ১৯৩০ সালে তিনি কলকাতায় প্রথমে স্কুল ইন্সপেক্টরের চাকুরিতে যোগদান করেন। ১৯৩০ সালের আগস্টে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে অনুষ্ঠিত ‘বঙ্গীয় মুসলিম সমাজ-সেবক-সংঘে’র বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতি হিসেবে তাঁর বক্তব্যটি নারী জাগরণের মাইল ফলক হয়ে আছে। এই অধিবেশনে তিনি বলেন ‘নারী-শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে অনেকেই অনেক কথা বলেছেন ও বলেন। নারী সমাজের অর্ধাঙ্গ, সমাজের পূর্ণতালাভ কোনোদিনই নারীকে বাদ দিয়ে সম্ভব হতে পারে না। সেই জন্যেই আজ এ সমাজ এতোটা পঙ্গু হয়ে পড়েছে। তিনি আরো বলেন, The highest form of society is one in which every man and woman is free to develop his or her individuality and to enrich the society what is more characteristic of himself or herself.

কাজেই এ সমাজের অবনতির প্রধান কারণ নারীকে ঘরে বন্দি করে রেখে তার Individuality বিকাশের পথ রুদ্ধ করে রাখা। নারী-শিক্ষা সম্বন্ধে এতোটা কথা আজ বলছি তার কারণ সমাজের গোড়ায় যে-গলদ রয়েছে সেটাকে দূরীভূত করতে না-পারলে সমাজকে কখনই সুন্দর করে গড়ে তুলতে পারা যাবে না।’

তিনি ১৯৩৫ সালে বেথুন কলেজে গণিতের অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন। বেথুন কলেজে চাকুরিরত অবস্থায় দেশবিভাগের পর তিনি ঢাকায় চলে এসে ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন ১৯৪৮ সালে।

বেগম ফজিলাতুন্নেছা ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা ইডেন কলেজের অধ্যক্ষা ছিলেন। বেগম ফজিলাতুন্নেছার অক্লান্ত পরিশ্রম ও চেষ্টায় বিজ্ঞান ও বাণিজ্যিক বিভাগসহ ইডেন কলেজ ডিগ্রি পর্যায়ে উন্নীত হয়। ১৯৫২ সালে ইডেন কলেজের মেয়েরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে কলেজের অভ্যন্তর থেকে মিছিল বের করার প্রস্ত্ততি নিলে উর্দুভাষী এক দারোগা হোস্টেলে ঢুকে মেয়েদের ভয়ভীতি দেখাতে শুরু করার এক পর্যায়ে খবর পেয়ে বেগম ফজিলাতুন্নেছা কলেজে এসে তার বিনানুমতিতে কলেজ প্রাঙ্গণে ঢোকার জন্য দারোগাকে ভৎসনা করে হোস্টেল থেকে বের করে দেন নিজের দৃঢ়তা ও প্রশাসনিক ক্ষমতার বলে। নারীশিক্ষা ও নারীমুক্তি সম্পর্কে সওগাতসহ অনেক পত্রিকায় তার বিভিন্ন প্রবন্ধ, গল্প প্রকাশিত হয়।

এই বিদুষী নারী ১৯৭৭ সালে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। এই মহীয়সী নারীর স্মৃতি রক্ষার্থে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৮৭ সালে ফজিলাতুন্নেছার নামে হল নির্মাণ করেন।

ড. সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন :

আরবি ভাষার এই সুমহান পন্ডিত ১৯০১ সালে ১ আগস্ট টাঙ্গাইল জেলাধীন মির্জাপুর থানার বানিয়ারা গ্রামে সুখ্যাত সৈয়দ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন সৈয়দ কেরামত আলী এবং মাতা সৈয়দা সাবেরুন নেছা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি প্রথম বিভাগে প্রথম নিয়ে ১৯২৪ সালে আরবিতে এমএ পাশ করেন। অতঃপর তিনি ক্লাসিকেল এরাবিক পোয়েট্রির উপর থিসিস লিখে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবিতে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৩০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি বিভাগে রিডার হিসেবে যোগদান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে (১৯৪৮-৫৩) সুখ্যাতি ও সুনামের সাথে কর্মরত থেকে একজন শিক্ষাবিদ হিসাবে দেশ ও জাতির প্রতি ক্রান্তিকালীন গুরুদায়িত্ব পালন করেন।

ডঃ সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণের পর পূর্ব পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন (১৯৫৩-৫৬) সাল পর্যন্ত। করাচি ইনকোয়ারী কমিটি সদস্য (পাকিস্তান সরকার ১৯৫৬-১৯৫৭) চেয়ারম্যান ইসলামিক (ত্ররাবিক) ইউনিভার্সিটি কমিশন (১৯৬৪-১৯৬৫)।

ডঃ সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন দেশ ও বিদেশের বহু পত্রপত্রিকায় ও সাময়িকীতে বিভিন্ন তথ্য ও তত্ত্বপূর্ণ প্রবন্ধ ও বহু বই প্রকাশ করেন, তার প্রকাশিত ইসলামিক পুস্তকসমূহের মধ্যে Early Arabic Odes, Dhaka, Kitab-al-Rumuz, Damascus, The Poems of Suragalb-Mirdan al-Driqi, Kitab-ul-ma’rifat-i-ulumi Hadith ইত্যাদি। তিনি ১৯৯১ সালে মৃত্যবরণ করেন।

হাতেম আলী খান : 

জন্ম ২৪ নভেম্বর ১৯০৪ সালে টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর থানার বেলুয়া গ্রামে। পিতা নায়েব আলী খান, মাতা সালমা খানম। জমিদার পরিবারে জন্ম নিলেও তিনি ছিলেন অবিভক্ত বাংলার বড় কৃষকনেতা। কৃষককুলের মধ্যে চেতনা, অধিকার প্রতিষ্ঠা ও তাদের জীবনে অর্থনৈতিক মুক্তি আনয়নই ছিল হাতেম আলী খানের জীবনের ধ্যান, জ্ঞান ও সাধনা। ১৯২০ সালে হেমনগর হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশের পর তিনি ১৯২১ সালে কলিকাতায় রিপন কলেজে ভর্তি হন। এ সময় তিনি দেশবরেণ্য সংগ্রামী নেতা সূর্যসেন, সত্যেনসেন, কবি নজরুল, জিতেন ঘোষ প্রমুখের সংস্পর্শে এসে বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত হন। ১৯২৪ সালে রিপন কলেজ থেকে আইএ পাশ করেন। কৃষকদের সাম্যবাদী নীতি ও জোতদারদের দাদন নীতির বিরুদ্ধে তিনি নিজ পিতা ও হেমনগরের জমিদারের বিরুদ্ধে ১৯২৫ সালে আন্দোলন করে সফল হন। ১৯২৬ সালে কলিকাতায় কমরেড মুজাফফর আহমেদের সান্নিধ্যে তিনি কমিউনিস্ট আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হন। স্ত্রীর অজান্তে ৭০ ভরি স্বর্ণের গহনা বিক্রি করে ‘সর্বহারা’পত্রিকা প্রকাশ করেন কলিকাতা থেকে। প্রায় ছয়মাস ‘সর্বহারা’পত্রিকাটি চালু ছিলো। এরপর তিনি চাষি, মজুর, দিন-মজুর নামে দুইটি পত্রিকা প্রকাশ করেন কুলির কাজ করে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে। সক্রিয় বিপ্লবী কর্মকান্ডে জড়িত থেকেও তিনি ১৯২৬ সালে বিএ ও ১৯২৮ সালে কলিকাতা থেকে এমএ পাশ করেন। ১৯৩৩ সালে তিনি কলিকাতা থেকে নিজ গ্রাম বেলুয়াতে চলে আসেন স্থায়ীভাবে। ১৯৪২ সালে তিনি নিজ এলাকার বলরামপুর, নলিন ও ধূবলিয়া গ্রামে একই সঙ্গে তিনটি হাইস্কুলের হেডমাস্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৬ সালের তেভাগা আন্দোলন তিনি প্রথমে টাঙ্গাইলে গড়ে তোলেন। আন্দোলনের এক পর্যায়ে তিনি বিপুল সংখ্যক প্রজা নিয়ে হেমনগরের জমিদার বাড়ি আক্রমণ করেন। এতে জমিদারের বহুলোক আহত হয়। নামে জমিদার ৩৯টি মামলা দায়ের করেন। কিন্তু একদিকে সাক্ষীর অভাব, অন্যদিকে টাঙ্গাইল মহকুমা বারের কোনো আইনজীবী জমিদারের স্বপক্ষে কথা বলতে অস্বীকার করায় এসব মামলা খারিজ হয়ে যায়। ১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় আসাম, ত্রিপুরা ও পশ্চিম বঙ্গ থেকে প্রায় ২০ হাজার উদ্বাস্ত্ত হেমনগর এসে উপস্থিত হলে তাদের একমাস খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করেন হাতেম আলী খান। ১৯৫৪ সালে তিনি যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে গোপালপুর থেকে বিজয়ী হন। ১৯৫৮ সালে ফুলছড়ি ঘাটে এক বিশাল কৃষক সম্মেলনে মওলানা ভাসানী সভাপতি ও তিনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। অতঃপর ১৯৬৩, ১৯৬৬, ১৯৭২ সালের কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ১৯৭৬ সালে সভাপতি ছিলেন। তিনি যখন যে প্ল্যাটফরমেই কাজ করেন না কেন, তার মূল কাজ ছিল কৃষকদের সংগঠিত করা। তিনি নিজ জেলা টাঙ্গাইল ছাড়াও রংপুর, দিনাজপুর, রায়পুর ও মুন্সীগঞ্জ অঞ্চলের তেভাগা সংগঠনে কাজ করেন নিষ্ঠার সাথে। কৃষক নেতা হাতেম আলী খান ১৯৭৭ সালের ২৪ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর সংগ্রামী জীবনে তিনি ১৩ বার কারানির্যাতন ভোগ করেছেন।

যাদুসম্রাট পিসি সরকার :

১৯১৩ সালে টাঙ্গাইল শহরতলীর আশেকপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম ভগবান সরকার মাতার নাম কুসুম কুমারী সরকার। পিসি সরকার ১৯৩৪ সালে বার্মা, জাপান, সিঙ্গাপুর ও চীনে যাদু প্রদর্শন করে সুখ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৫৭ সালে যাদুকর পিসি সরকার লন্ডনে বিবিসি টেলিভিশনে বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে তরুণী দ্বিখন্ডিত করার খেলাটি প্রদর্শন করেন। খেলাটি টেলিভিশনে দেখেই অনেকে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তাঁর উল্লেখযোগ্য খেলার মধ্যে শূন্যে ঝুলন্ত কঙ্কাল, এক্স-রে চক্ষুর খেলা, জ্যান্ত হাতি অদৃশ্য করা, মোটরগাড়ি অদৃশ্য করা ইত্যাদি উল্ল্যেখযোগ্য।

তিনি ছেলেদের ম্যাজিক, ম্যাজিকের কৌশল, ম্যাজিকের খেলা, সহজ ম্যাজিক, মেসমেরিজম, সম্মোহন বিদ্যা ইত্যাদি সহ ১৮-১৯টি বই লিখেছেন। ১৯৬৪ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত করেন। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোসের নির্দেশে তিনি জাপানে যাদু প্রদর্শন করে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য গঠিত আজাদ হিন্দু ফৌজকে অর্থ সাহায্য করেন। বিশ্বখ্যাত এই যাদুকর ১৯৭১ খ্রি: জাপানের তাবেৎসু (সাপোরো) শহরে মৃত্যুবরণ করেন।

ডঃ এমএনহুদাঃ

এই পন্ডিত ব্যক্তি (১৯১৯) সালে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে টাঙ্গাইল থানার অন্তর্গত (বর্তমানে দেলদুয়ার থানা) জাঙ্গালিয়ার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মৌলভী মির্জা আব্দুল করিম। টাঙ্গাইল বিন্দুবাসিনী হাই স্কুল থেকে ক্লাসের ফার্স্টবয় হিসাবে চারটা লেটার ও স্টার পেয়ে দশ টাকা করে মাসিক বৃত্তি পেয়ে ১৯৩৫ সালে মেট্রিক পাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪০ সালে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে অনার্স পাশ করেন। তিনি ঐ বছর অনুষ্ঠিত সর্ববিষয়ে অনার্স গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে প্রথম হওয়াতে তৎকালীন দুর্লভ বৃত্তি রাজা কালিনারায়ন স্কলারশীপে ভূষিত হন। তিনি প্রথম মুসলিম ছাত্র, যিনি এই দুর্লভ কৃতিত্বের অধিকারী হন। অতঃপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হন। মরহুম তমিজ উদ্দিন খান কলিকাতাতে প্রাদেশিক মন্ত্রী ছিলেন। তমিজ উদ্দিন খানের দ্বিতীয় কন্যা কুলসুমের সঙ্গে তিনি ঐ সময় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ২৬.০১.১৯৪৫ সালে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে চাকুরি শুরু করেন। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকুরিকালীন অবস্থাতেই যুক্তরাষ্ট্র সরকার ভারতীয়দের জন্য বেশ কিছু ওভারসীজ বৃত্তির ঘোষণা পত্রিকা মাধ্যমে প্রচার করেন। ডঃ এমএন হুদার বৃত্তির জন্য দরখান্ত করেন এবং নির্বাচিতও হন। ওভারসীজ স্কলারশীপ নিয়ে ডঃ এমএন হুদা ১৯৪৭ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪৯ সালে সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকোনোমিকসের রিডার হিসাবে যোগদান করেন। ডঃ হুদা ১৯৬৫ সালে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী হিসাবে যোগদান করেন এবং তিনি এই পদে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত অধিষ্ঠিত ছিলেন। এরপর ১৯৬৯ সালের ৩ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পদে নিযুক্ত হয়ে শপথ গ্রহণ করেন। কিন্তু ২৫ মার্চ দ্বিতীয় সামরিক অভ্যুত্থানে জেনালে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং ডঃ হুদার গভর্নরের কার্যকাল শেষ হয়ে যায়। ডঃ হুদা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক পদে চলে যান। ১৯৭৫-এর ২৬ নভেম্বরের পূর্ব পর্যন্ত তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার সাথে যুক্ত থাকেন, অতঃপর প্রেসিডেন্ট সায়েম তাকে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ করে পরিকল্পনা বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছাড়াও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কিছু দায়িত্বও অর্পণ করেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে তিনি মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও প্রেসিডেন্ট সাত্তারের আমলে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৯১ সালের ২২ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীঃ 

আবু সাঈদ চৌধুরীর জন্ম ৩১ জানুয়ারি ১৯২১ মানিকগঞ্জ জেলার এরাচিপুর গ্রামে মাতুলালয়ে। তার পিতার বাড়ি কালিহাতির নাগবাড়িতে। পিতা স্পিকার আব্দুল হামিদ চৌধুরী, মাতা শামসুন নেছা চৌধুরী। শিক্ষা জীবনে তিনি কলিকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ (১৯৪০) পাশ করেন, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ও ল পাশ। লন্ডনের লিস্কস ইন থেকে ১৯৪৭ সালে ব্যারিস্টারি পাশ করে দেশে ফিরে আসে। তিনি খ্যাতনামা ছাত্রনেতা ছিলেন। আবু সাঈদ চৌধুরী প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক (১৯৪০), নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক (১৯৪০), নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের ব্রিটিশ শাখার সভাপতি (১৯৪৬) ছিলেন। কর্মজীবনে তিনি ১৯৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের এডভোকেট জেনারেল নিযুক্ত হন। ১৯৬১ সালে তিনি ঢাকা হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারক পদে এবং স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান ১৯৬২ সালে। তিনি পাকিস্তান শাসনতন্ত্র কমিশনের সদস্য (১৯৬০-৬১) ও কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের সভাপতি (১৯৬৩-৬৮) ছিলেন। তিনি ১৯৬৯ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান। ১৫ মার্চ ১৯৬৯ সালে তিনি জেনেভায় অবস্থানকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের গুলিতে হত্যঅর প্রতিবাদে জেনেভা থেকে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে তিনি পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে জাতিসংঘে অবস্থা করছিলেন। ২৫ মার্চের কালরাত্রির বিবরণ বিবিসিতে জেনে পাকিস্তান সরকারের পক্ষত্যাগ করে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে বিশ্বব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন। আবু সাঈদ চৌধুরী ২৩ এপ্রিল ১৯৭১ প্রবাসে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ পান। লন্ডনে আবু সাঈদ চৌধুরীর তত্ত্বাবধানেই স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদের কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। স্বাধীনতার পর তিনি ১৯৭২ সালে ১২ জানুয়ারি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। ১৯৭৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ এবং একজন কেবিনেট মন্ত্রীর পদমর্যাদায় সরকারের আন্তর্জাতিক বিষয়াদির বিশেষ প্রতিনিধি নিযুক্ত। ১৯৭৫ এর ৮ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বাকশাল দলীয় সরকারের বন্দর, জাহাজ চলাচল ও অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন দপ্তরের মন্ত্রী নিযুক্ত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিহত হবার পর খোন্দকার মোশতাক আহমদের মন্ত্রীসভায় তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী (২০ আগস্ট-৬ নভেম্বর ১৯৭৫) ছিলেন। ১৯৭৮ এ জাতিসংঘের সংখ্যালঘু বৈষম্য প্রতিরোধ ও অধিকার সংরক্ষণ কমিশনের সদস্য নির্বাচিত। ১৯৮৫-১৯৮৬-তে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান। উদার গণতন্ত্রী, মানবতাবাদী ও বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের প্রতি আস্থাশীল এ বুদ্ধিজীবী বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশীকোত্তম উপাধি ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর-অব-ল ডিগ্রি লাল করেন।

মুফাখখারুল ইসলামঃ

জন্ম ৩০ এপ্রিল, ১৯২১, ঘাটাইল থানার অন্তর্গত বেনীমাধব গ্রামে। তাঁর পিতৃভূমি পার্শ্ববর্তী নূরপাড়া গ্রাম। পিতার নাম মৌলভী ময়েজ্জদ্দীন উয়ায়সী, মাতা নাজিরুন্নিসা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৯ সালে বাংলাভাষা ও সাহিত্যে ২য় শ্রেণীতে ১ম স্থান অধিকার করে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ, ঢাকা কলেজ এবং সর্বশেষ খুলনা সরকারি মহিলা কলেজে অধ্যাপনার পর অবসর গ্রহণ করেন। বহুমুখি প্রতিভার অধিকারী এই জ্ঞানতাপস একাধারে করি, প্রাবন্ধিক, ইতিহাসবিদ ও নাট্যকার। এসবের বাইরেও তিনি উয়ায়সী তরিকার একজন আধ্যাত্মিক সাধক। টাঙ্গাইলের ইতিহাস ঐতিহ্য চর্চায় মুফাখখারুল ইসলামকে প্রাণপুরুষ বলা যায়। টাঙ্গাইলের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাসের নানা অজানা তথ্য তিনি উন্মোচন করেছেন। তাঁর রচিত বিভিন্ন প্রবন্ধ যেমনঃ ‘টাঙ্গাইলে ইসলাম’টাঙ্গাইল জেলা সাধারণ ইতিহাস প্রসঙ্গে’ইত্যাদি প্রবন্ধের অনুসন্ধানী ব্যাখ্যায় আমরা খুঁজে পেয়েছি কালিহাতি থানার বন্দ-ই-শহর বা ভন্ডেশ্বর, ভূঞাপুরের রাজা রায়ের ভিটা, হাট সুলতান নগর, ঘাটাইলের সাগরদীঘি, ঝরোকো, গুপ্তবৃন্দাবন, দেলদুয়ার থানার আল-ই-ইয়াসীন বা এলাসিন সম্পর্কে নব-নতুন তথ্য। এছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে, প্রবন্ধঃ ভাষা ও রচনারীতি, আল্লাহকে দেখা যায়, ইসলাম পথের বাধা, ইতিহাসের ফাঁক ও ফাঁকি, ইতিহাসগত বিভ্রান্তির রহস্য। নাটকঃ মুরশিদ (১৯৭০), আর্তনাদ (১৯৫৮), আশ্রিত (১৯৫০), ঈদের খুশি (১৯৭০), বয়াতি (১৯৭০), হকীম বুআলী সীনা সলেমান আবসাল, হেনা, আদহাম-আশিক, আল্লাহর মর্জি। একাস্কিকাঃ তোবাতুন নসুহা, মারাঠা মর্দিন, ইন্টারভিউ, এলাচিপুরের মুন্সেফ। কিশোর নাটকঃ ইমানপরখ, বড় ঈদ, প্রহরী পুত্র ও মজনু ফকির। মুফাখখারুল ইসলাম ২০০৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।

অধ্যাপক ডঃ মফিজ উদ্দিন আহমেদঃ ১৯২১ সালে ২ মে ঘাটাইল উপজেলার গাংগাই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম আহাদউল্লা সরকার। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে ১৯৪২ সালে এবং ১৯৪৪ সালে যথাক্রমে বিএসসি (সম্মান) ও এমএসসি ডিগ্রি লাল করেন প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। অতঃপর ১৯৪৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পেনসেলভিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিইচডি ডিগ্রি লাভ করেন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাসায়ন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালীন তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। এই কৃতী শিক্ষাবিদ জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর নিযুক্ত হয়ে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে বিভাগীয় চেয়ারম্যান, সিনট, সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন। ডঃ মফিজ বহু পেশাগত ও সামাজিক সংগঠনের সাথেও নানাভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফি লামডো আফসিলন’(১৯৪৭) ও সিগমাসিকস (১৯৪৮) সদস্য, ১৯৬৯ সালে সেন্ট্রাল পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য, স্বাধীনতার পর বিসিএসআই, আর এর প্রথম চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ক্যামিকেল সোসাইটির সভাপতি (১৯৭৩-৮০) ও জাতীয় শিক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান (১৯৮৭) ছিলেন। তাঁর রচিত অসংখ্য গবেষণা প্রবন্ধ দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও জার্নালে প্রকাশিত হয়ে প্রশংসিত হয়। তিনি ১৯৬৬ সালে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকারের তমঘা-ই-পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সরকারের মহান স্বাধীনতা দিবস সম্মানে ভূষিত হন ১৯৮৬ সালে। এই পন্ডিত ব্যক্তি ১৯৯৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। আবু সাঈদ চৌধুরীর বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রয়েছেঃ প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি, হিউম্যান রাটস ইন টুয়েনটিয়োথ সেঞ্চুরী’এবং মুসলিম ফ্যামিলি ল ইন ইংলিশ কোর্স ইত্যাদি। তিনি ১৯৮৭ সালে আগস্ট মাসের ২ তারিখে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনের একটি আন্ডারগ্রাউড স্টেশনে নিঃসঙ্গ অবস্থায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

শামছুল হক: ১লা ফেব্রুয়ারি ১৯১৮ সালে বর্তমান টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলার এলাসিন ইউনিয়নের শাকইজোড়া গ্রামের মাতুলালয়ে শামসুল হকের জন্ম। তার  পিতার নাম দবির উদ্দিন সরকার মাতা-শরিফুন্নেছা। পিতা দবির উদ্দিন ছিলেন দেওলি ইউনিয়নের মাইঠান- টেউরিয়া গ্রামের একজন আদর্শ কৃষক। চারভাই দুই  বোনের মধ্যে শামসুল হক ছোট বেলা থেকেই পড়ালেখায় ভাল। নিজ গ্রামের মসজিদ মাদ্রাসায় বাল্যশিক্ষা গ্রহন করে টেউরিয়া নিমণ প্রাথমিক স্কুল থেকে তৃতীয় শ্রেণী পাশ করেন। এলাসিন স্বর্ণময়ী মাধ্যমিক স্কুলে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণী পর্যমত্ম পাঠ শেষ করে পোড়াবাড়ী মাধ্যমিক স্কুলে সপ্তম শ্রেণী পর্যমত্ম পড়ালেখা করেন। এরপর ১৯৩৫ সালে সমেত্মাষ জাহ্নবী হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন। এখান থেকেই শামসুল হকের জীবনে রাজনৈতিক সচেতনতা, কর্মপন্থা ও কার্যক্রম শুরম্ন হয়। ১৯৩৬ সালে তিনি প্রথম মুসলিম লীগের সদস্য হন। ১৯৩৮ সালে এই স্কুল থেকে তিনি কৃতিত্বের সাথে প্রবেশিকা ( মেট্রিকুলেশন) পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে করটিয়া সা’দত কলেজে ভর্তি হন। তখন কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন ইব্রাহিম খাঁ। শামসুল হকের রাজনৈতিক পরিমন্ডল বাড়তে থাকে। ছাত্রদের প্রয়োজনে কলেজের ছাত্র সংসদ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এবং ১৯৩৯ সালে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় ছাত্র সংসদের সহ সভাপতি (ভি.পি) নির্বাচিত হন। ১৯৪০ সালে এই কলেজ থেকে তিনি প্রথম বিভাগে আই.এ পাস করেন। এরপর রাজনীতির বৃহত্তর অঙ্গনে পা রাখতে জীবনের কঠিন ব্রত নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে প্রথম বর্ষে (সম্মান শ্রেনিতে ) ভর্তি হন। অল্প দিনের মধ্যে রাজনীতির ময়দানে ছাত্র নেতাদের মধ্যে সেরা হয়ে উঠেন শামসুল হক। পড়ালেখায় কিছুটা ঘাটতি দেখা দিলেও ১৯৪৩ সালের চূড়ামত্ম পরিক্ষায় স্বল্প সময়ের প্রস্ত্ততিতে বি.এ (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর আর এম.এ ডিগ্রি অর্জন করা হয়নি। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের এক অধিবেশনে যুক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হকের লাহোর প্রসত্মাব উত্থাপনের সময় (২২ মার্চ) শামসুল হকের রাজনৈতিক মঞ্চে অভ্যুদয় ঘটে। এ সময় ছাত্র নেতৃবৃন্দের প্রতিনিধি হিসেবে তার সাথে পরিচয় ঘটে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের। লাহোর প্রসত্মাবের মূল বিষয়‘‘ ভারতের উত্তর পূর্ব ও উত্তর পশ্চিমাংশে স্বাধীন ও সার্বভৌম মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে- এর ভিত্তিতে নিজের মন প্রান উজার করে বড় বড় রাজনীতিবিদদের সাথে জনমত গঠনে সারা বাংলা চষে বেড়ান। বাংলার মুসলমান সমাজ মুসলিম লীগের পতাকাতলে সংগঠিত ও সমবেত হতে থাকে। ১৯৪৫-১৯৪৬ সালে প্রাদেশিক ও সাধারন নির্বাচনে মুসলিম লীগ এই বাংলার বিজয় লাভ করেন। বাংলার জনগন চিনে নেয় শামসুল হককে। দেশ বিভাগের সময় হয়। ১৪ ই আগস্ট ১৯৪৭ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিসত্মান প্রতিষ্ঠা পায়। পূর্ব পাকিসত্মান ও পশ্চিম পাকিস্তান- মাঝখানে ব্যবধান পায় ১২০০ মাইল। শাসন পরিচালনায় পশ্চিম পাকিসত্মানি গোষ্ঠি আর পূর্ব বাংলার তাবেদারি মুসলমান নাম ধারী জমিদার বেনিয়া গোষ্ঠি । শরম্নতেই সাধারন মানুষের জন্য ত্যাগী,সংগ্রামী মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাসিম প্রমুখকে মুসলিম লীগের রাজনীতি থেকে বিতাড়িত করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় শামসুল হককে ও মুসলিম লীগের রাজনীতি থেকে বিতাড়িত করা হয়।  তাই এই অবসরে তিনি ‘গণতান্ত্রিক যুবলীগ’ নামে সংগঠনের আত্নপ্রকাশ ঘটান। তরম্নন ও যুব নেতৃবৃন্দ তার সাথে যোগ দেয়। ১৯৫০ সাল মোগলটুলি, ঢাকা অফিসে অনেকেরই যাতায়াত বাড়তে থাকে। বিভিন্ন প্রশ্নে যেমন ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি গন দাবি খাদ্য সমস্যা সম্পর্কে মানুষের কাছাকাছি যেতে চেষ্টা করে। কিন্তু বেশিদিন টিকতে পারে না। এরপর শামসুল হক আবুল হাসিমের সহযোগিতায় মোগলটুলি অফিসে শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও হাসিম পন্থি লোকদের নিয়ে ‘‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’’ চালু করেন। যেখানে কামরম্নদ্দিন আহাম্মদ, অলি আহাম্মদ , মোহাম্মদ তোয়াহা, তসদ্দুক আহম্মদ , তাজউদ্দিন আহম্মদ প্রমুখ এবং কলকাতা কেন্দ্রিক রাজনীতি থেকে আগত খন্দকার মোসতাক আহম্মদ ,শেখ মুজিবর রহমান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ সংগঠিত হতে শুরম্ন করেন। এদিকে পূর্ব পাকিসত্মানে বাংলার পরিবর্তে উর্দু কে রাষ্ট্রভাষা করার সরকারি সিদ্ধামেত্মর বিরম্নদ্ধে মানুষ সোচ্চার হতে থাকে। গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। শামসুল হক এখানে সক্রিয় ভূমিকা রেখে চলেন। ১৯৪৮ সালের মার্চে ভাষার প্রশ্নে চারদিনও কারাবরন করেন তিনি। ২১ মার্চ ১৯৪৮ রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানের গর্ভনর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার ভাষনের এক পর্যায়ে ‘উর্দু এন্ড অনলি উর্দু শ্যাল বি দ্যা স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অব পাকিস্তান’ বলে ঘোষনা দেন। জিন্নাহর মুখেরকথা শেষ হবার সাথে সাথে শামসুল হক ‘নো’, ‘নো’বলে চিৎকার করে দাঁড়িয়ে পড়লেতার সাথে সাথে আরো অনেকে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেন। ঐ-দিন সন্ধ্যা ৬.৩০ মিনিটেজিন্নাহ’র সাথে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধিদের সাক্ষাৎকালে শামসুল হকবলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। শামসুল হকের বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষেযুক্তি তর্কে জিন্নাহ রাগান্বিত স্বরে শামসুল হককে উদ্দেশ্য করে বলেন, You are the man who always create trouble. I remember that you created trouble convention also along with Moulana Hasrat Moulana Abdul Hamid Khan Bhashasni and Abul Hashim?। তাছাড়া সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটির সাথে মি. জিন্নাহর যে বৈঠক হয় সেখানেও শামসুল হক ভাষার প্রশ্নে তার সাথে মতবিরোধে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪৯ সালে প্রথম পূর্ব ও পশ্চিম পাকিসত্মানে ৩৫ আসনের মধ্যে একটি টাঙ্গাইল মহকুমার দক্ষিনের মুসলিম আসনের উপনির্বাচনে মওলানা ভাসানি বিজয়ী হলে তা বাতিল করা হয়। ২৬ শে এপ্রিল পুনরায় উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষনা হলে প্রার্থী হন শামসুল হক। তার নিজের এলাকা কিন্তু তিনি সহায় সম্বল হীন। ওয়ার্কার্স ক্যাম্প নেতৃবৃন্দের বিপুল উৎসাহ , উদ্দিপনা ও সহযোগিতা পেলেন। বিপরীতে মুসলিম লীগের প্রার্থী করটিয়ার বিখ্যাত জমিদার পুত্র খুররম খান পন্নী। তার পিছনে মন্ত্রিবর্গ সহ নুরম্নল আমিনের সরকার। এরপরও শামসুল হক বিজয় ছিনিয়ে আনেন। কিন্তু বিধি বাম এবারও চক্রামত্ম করে নির্বাচনের ফল বাতিল করা হয়। এর ফলে রাষ্ট্র পরিচালনায় নানা ব্যর্থতা ও অযোগ্যতা তুলে ধরতে শামসুল হক নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনে সর্বাত্নক প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। একে একে যোগাযোগ করেন শেরে বাংলা , হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বগুড়ার মোহাম্মদ আলী প্রমুখের সঙ্গে। তাদের কোন সাড়া না পেয়ে আসামের কারাগারে বন্দি মওলানা ভাসানীর সাথে যোগাযোগ করেন। এক পর্যায়ে মওলানা ভাসানী কারামুক্ত হয়ে ঢাকায় ফিরলে ২৩ ও ২৪ জুন (১৯৪৯) এক সম্মেলন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’। মওলানা ভাসানী হলেন সভাপতি, শামসুল হক সাধারন সম্পাদক, আর যুগ্ন সাধারন সম্পাদক করা হয় খন্দকার মোশতাক ও শেখ মুজিবকে। শামসুল হকের নেতৃত্বে অতি দ্রম্নত আওয়ামী মুসলিম লীগ বিরোধী দল হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে। ১১ অক্টোবর (১৯৪৯) পাকিসত্মানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান , পূর্ব পাকিসত্মান সফরে আসলে দেশের দূরবস্থা ও খাদ্য সংকটের প্রতিবাদে আওয়ামী মুসলিম লীগ একটি জনসভা ও বিক্ষাভের আয়োজন করে। বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের সাথে গোলযোগ দেখা দিলে মওলানা ভাসানী , শামসুল হক সহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে নুরম্নল আমিনের সরকার । তাদের কারাগারে প্রেরণ করে। ১৯৫১ সালের মার্চ মাসে শামসুল হক মুক্তি পান। দীর্ঘ সময় কারাভোগের পর তিনি ধর্মকর্ম ও পরিবারের প্রতি মনোযোগী হন। একই সাথে দলের কার্যক্রম সুচারম্ন ভাবে চালিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু সুবিধাবাদী অনেকে তার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে তাকে সংগোপনে দলের নেতৃত্ব থেকে অপসারনের প্রস্ত্ততি নিতে শুরম্ন করে। এক সময় ক্রমশ ঝিমিয়ে পড়া ভাষা আন্দোলনের জোয়ার জেগে উঠে। ১৯৫১ সালের মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্র ভাষা কমিটি কমিটি গঠিত হয়। আর ১৯৫২ সালে ৩১ শে জানুয়ারি গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। ২১ শে ফেব্রম্নয়ারি পূর্ব পাকিসত্মানের সর্বত্র সাধারন ধর্মঘট পালনের সিদ্ধামত্ম নেয়া হয়। ২০ ফেব্রম্নয়ারি সন্ধ্যা থেকেই নুরুল আমিন সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। ভাষা সংগ্রাম পরিষদের এক সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষ বিপক্ষ মতানৈক্য দেখা দিলে ( বিপক্ষ সদস্যদের মতামত উপেক্ষিত হওয়ায়) শামসুল হকের প্রসত্মাব অনুসারে তা ভোটে দিলে বিপক্ষের মতামত  ১১:৪ ভোটে পাস  হয়। তা সত্ত্বেও অলি আহাদ, আব্দুল মতিন, শামসুল আলম ও গোলাম মওলা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষ দৃঢ় অবস্থান নেয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ২১ ফেব্রম্নয়ারি পুলিশের গুলিতে কয়েকজন শহীদ হন। শামসুল হক ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার যুক্তি ছিল-‘‘ ভাষা আন্দোলন যে পর্যায়ে উপনীত হয়েছে তাতে শামিত্মপূর্ণ উপায়ে আন্দোলন চালানো বাঞ্চনীয়, যেহেতু সরকার বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলায় কারোরই কোন সাংগঠনিক শক্তি বা প্রস্ত্ততি নেই। তাছাড়া পরবর্তি বছরই সাধারন নির্বাচন হওয়ার কথা, এ কারনে এ আন্দোলনকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনে জয় লাভের মাধ্যমে বাংলাকে দেশের রাষ্ট্রভাষা করা আমাদের  জন্য সহজ হবে।’’ এতদ্বসত্ত্বেও শামসুল হক ২১ ফেব্রম্নয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সকাল থেকে দুপুর পর্যমত্ম ছাত্র নেতৃবৃন্দের সাথে বিভিন্ন সলাপরামর্শ ও বক্তৃতা করা ছাড়াও এক পর্যায়ে তাদের অবস্থানের প্রতি ব্যক্তিগত ভাবে সহমত পোষন করেন। পুলিশের গুলিবর্ষনেও তিনি পিছপা হননি। বিকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে আহত ছাত্রদের সেবা শুশ্রম্নষায় এগিয়ে আসেন। এরপর থেকেই বোঝা যায় রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শামসুল হকের অবদান অতুলনীয়, অপরিসীম এবং অবিস্মরনীয়। ১৯৪৯ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর শামসুল হক আফিয়া খাতুনের সঙ্গে (ইডেন কলেজের ইংরেজি শিক্ষিকা,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব পরিচিতা) বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।  ৯ই এপ্রিল ১৯৫১ সালে তাদের প্রথম কন্যা উম্মে বতুল তাজমা তাহেরা (শাহীন)এবং ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৫২ সালে দ্বিতীয় কন্যা উম্মে বতুল ফাতেমা জহুরা (সায়কা) জন্মগ্রহন করেন। বর্তমানে তার কন্যাদ্বয় পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে আমেরিকায় প্রবাস জীবন যাপন করছেন। আবার  ভাষা আন্দোলনের জন্য ১৯-০৩-১৯৫২ সালে কারাবরন করলেন শামসুল হক। ১৯৫৩ এর ১৩ ফেব্রম্নয়ারি কারাবরন হতে মুক্তি পেলেন তিনি। জেল গেটের বাইরে হাজার হাজার মানুষ তার অপেক্ষায় ছিলেন। তাকে দেখে জনগন আনন্দে করতালি ও শেস্নাগান করলেন। তিনি স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে স্মিত হাস্যে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানালেন। পরবর্তিতে সেখান থেকে সে সরাসরি ঢাকার শ্বশুরালয়ে যান । সেখানে গিয়ে দেখতে পান তার স্ত্রী ও সমত্মানরা দেশ ত্যাগ করে নিউজিল্যান্ড চলে গেছেন। এ বিষয় নিয়ে তার শ্বশুর বাড়ীর লোকজনদের সাথে তার তর্ক বিতর্ক হয়। এক পর্যায়ে শামসুল হক হালকা রকমের আহত হন। এরপর ধীরে ধীরে পারিবারিক ও ব্যক্তিগত ভাবে নিঃসঙ্গ ও একাকী হয়ে পড়েন আর রাজনৈতিক ভাবে হন অবহেলার শিকার। এ সময় প্রবল মানসিক যন্ত্রনা ও বিরহ ব্যাথায় পৃথিবীর বস্ত্ত জগতের ও স্বাভাবিক জীবন প্রবাহ থেকে ছিটকে পড়েন তিনি। শুরম্ন হয় তার উদ্ভট ও ভাবলেশহীন জীবন যাপন। জীবনের শেষবেলা কাটে হাটে-ঘাটে-মাঠে, নদীতে ও নৌকায়। দূর্ভাগ্যবশত ১৯৬৫ সালে তৎকালিন পূর্ব পাকিসত্মানে একদিকে আয়ুব খানের সামরিক শাসন, পাক ভারত যুদ্ধ, অন্যদিকে রাজনীতি বন্ধ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বিরম্নদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। ঐ সময় শামসুল হক সব কিছু হারিয়ে মনে মনে নানা প্রকার বিচ্ছেদ, যন্ত্রনা, অসহায়ত্ব, ভগ্ন রোগাক্রামত্ম স্বাস্থ্য নিয়ে অসুস্থ অবস্থায় তৎকালিন টাঙ্গাইল মহকুমার কালিহাতি থানার দূর্গাপুর ইউনিয়নের জোগারচড় এলাকার কদিমহামজানি গ্রামের শামসুল হকের সুপরিচিত স্বদেশী আন্দোলনের কংগ্রেস নেতা মৌলভি মহির উদ্দিন আনসারি সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় নেন। তাকে কংগ্রেস নেতার ছেলেরা স্থানীয় ডাক্তার দ্বারা বেশ কিছু দিন চিকিৎসা করান। চিকিৎসা চলাকালিন অবস্থায় শামসুল হক সাহেব ১৯৬৫ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। ঐ সময়ের তাগিদে কংগ্রেস নেতার ছেলেরা  সমাজের কিছু সংখ্যক লোক নিয়ে কদিমহামজানি গ্রামের স্থানীয় কবরস্থানে শামসুল হক সাহেবকে দাফন করেন। শামসুল হকের মৃত্যুর আগ মুহূর্ত হইতে প্রায় এক যুগ কেটেছিল দেশের মানুষের সামনে অচেনা, অজানা, অকাতর ,অবহেলা ও অসহায় অবস্থায়। অবশেষে তাহার মৃত্যু হয় পরিবার ও আত্নীয় স্বজনের অগোচরে এবং দেশবাসীর অজামেত্ম। এরপর ২০০৭ সালে ঐ গ্রামের ডাঃ আনছার আলী তালুকদার সহ যারা দাফন করার সময় উপস্থিত ছিলেন। তারা শামসুল হকের অনুসারি ডাঃ সাইফুল ইসলাম স্বপন, তৃনমূল নেতা কৃষক আব্দুল গফুর বেপারী এবং স্যাটেলাইট চ্যানেল এনটিভি ও দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার টাঙ্গাইল প্রতিনিধি সাংবাদিক মহববত হোসেন সহ অন্যান্য ব্যক্তিবর্গের নিকট শামসুল হকের মৃত্যুর বিস্তারিত কাহিনী খুলে বলেন এবং তার কবরটি চিহ্নিত করে দেখান। সেই অনুসারে শামসুল হকের জন্মভূমি দেওলি ইউনিয়ন সেই ইউনিয়নের তার অনুসারি ও ভক্ত তৃনমূল নেতা কৃষক আব্দুল গফুর বেপারী, ডাঃ সাইফুল ইসলাম স্বপন সহ অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ শামসুল হকের কবরটি ইট দ্বারা বাধিয়া রেখেছেন। শামসুল হকের ‘বৈপ্লবিক দৃষ্টিতে ইসলাম’ মুসলমানদের জন্য সুসমন্বিত জীবন ব্যবস্থাকল্পে অনুপম ভা